গত দুই দশকে আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশ উন্নতি করেছে। এটা এশিয়ায় যেমন হয়েছে, তেমনি আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায়ও হয়েছে। এর কারণ হচ্ছে, গত ২০ বছরে বৈশ্বিক প্রক্রিয়ায় অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। বিশেষ করে ব্যবসা ও বিনিয়োগ এক দেশ থেকে আরেক দেশে অনায়াসে প্রবাহিত হয়েছে। ছোট অর্থনীতির অনেক দেশ এই সুযোগ গ্রহণ করতে সক্ষম হয়েছে। এই সময়ে সংঘটিত ‘গ্লোবাল লিবারালাইজেশন’-এর কারণে সুযোগটা গ্রহণ করা সম্ভব হয়েছে। গত ২০ বছরে আমরা এর মাধ্যমে উপকৃত হয়েছি এবং শেষ ১০ বছরে বেশি উপকৃত হয়েছি। এর মধ্যে অনেক দেশ দিপক্ষীয় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) ও অগ্রাধিকার বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ) করেছে। আবার অনেকে ওভারল্যাপিংও করেছে। অর্থাৎ তারা দ্বিপক্ষীয় এফটিএ বা পিটিএ করার পাশাপাশি বড় ইকোনমিক ব্লক তথা আঞ্চলিক মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিও করেছে; যেমন—ভারত আসিয়ান জোটের সঙ্গে করেছে। এ ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে আছি। তা সত্ত্বেও আমরা যখন নিজেদের উন্নতির পথটা খুঁজে পেয়েছি, তখন থেকেই মূলত আমাদের অগ্রযাত্রা বেগবান হয়েছে। এখন আমাদের মনোনিবেশ সেদিকেই ধরে রাখতে হবে।
জিডিপির আকারে সাড়ে তিন শ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির দেশ আমাদের। এই আকারের অর্থনীতি হিসেবে বাংলাদেশ একমাত্র দেশ, যার কোনো দ্বিপক্ষীয় এফটিএ নেই। এমনকি বড় কোনো আঞ্চলিক অর্থনৈতিক ব্লকের সদস্যও হতে পারিনি। একসময় সাপটা করা হয়েছিল, কিন্তু এখন অকার্যকর। বাদবাকি কিছুই আমাদের হয়নি। আমরা যতটা উন্নতি করেছি সেটা জনশক্তি রপ্তানির মাধ্যমে এবং রপ্তানিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোটা সুবিধার মাধ্যমে। জিএসপি বাতিলের পর যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের তৈরি পোশাক প্রতিযোগিতা করেই টিকে আছে। এ জন্যই আমাদের উন্নতির যাত্রাও অব্যাহত রয়েছে।
এক দশক আগেও ছোট অর্থনীতির দেশগুলো বিশ্বব্যাংকের নেতৃত্বাধীন এইড কনসোর্টিয়ামের ওপর নির্ভরশীল ছিল। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে কয়েকটি রাষ্ট্র ও সংস্থা একসঙ্গে বৈঠকে বসে সিদ্ধান্ত নিত, কিভাবে দরিদ্র দেশগুলোকে সাহায্য করবে। এটা তখন প্যারিস কনসোর্টিয়াম নামে পরিচিতি পায়। তখন প্রতিবছর বাজেটের কয়েক মাস আগে আমাদের অর্থমন্ত্রীরা বৈঠকে অংশ নিতে প্যারিসে যেতেন খয়রাতি সহায়তা চাওয়ার জন্য। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাস এলে আমরা প্যারিসের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। তখন বলা হতো, ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে আমাদের অর্থমন্ত্রীরা প্যারিসে যান। এগুলো এখন আর হচ্ছে না। তখন আমাদের উন্নয়ন বাজেট ৮০ শতাংশই আসত এই উৎস থেকে। তখন আমাদের উন্নয়ন বাজেটও খুব ছোট ছিল। ফলে আমরা রাস্তা নির্মাণ করতে পারিনি, বন্দরের উন্নয়ন করতে পারিনি, আরো অনেক কিছুই করতে পারিনি। এই প্যারিস কনসোর্টিয়ামের ওপর আমরা ২০-২৫ বছর নির্ভরশীল ছিলাম। ওখান থেকে কথিত খয়রাতি সাহায্য কী আসবে না আসবে তার ওপর আমাদের বাজেট প্রণয়ন নির্ভর করত। আমরা যত দিন প্যারিস কনসোর্টিয়ামের ওপর নির্ভরশীল ছিলাম, আমাদের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশের মধ্যে আটকে ছিল।
পরবর্তী সময়ে যখন আমরা সেখান থেকে সরে এসে একটু এক্সপোর্টের দিকে নজর দিলাম জনশক্তি ও তৈরি পোশাকের মাধ্যমে, তখন গাঝাড়া দিয়ে উঠলাম। এটা ঘটতে থাকল ২০০০ সালের পর থেকে। প্যারিস কনসোর্টিয়ামে বড় বড় দেশ ও দাতা সংস্থা অংশ নিত। লক্ষণীয় বিষয় ছিল, তারা কখনোই কোনো একক প্রকল্প বা কোনো বড় প্রকল্পের জন্য অর্থায়ন করত না। এরা ছোট ছোট প্রকল্পের জন্য অর্থ দিত, কিন্তু বড় বড় শর্ত বেঁধে দিত। এক বিলিয়ন ডলার বা দুই বিলিয়ন ডলারের কোনো প্রকল্পে এরা অর্থায়ন করত না। তাদের শর্তের কারণে আমাদের চাহিদামতো উন্নয়নকাজ আমরা করতে পারতাম না। এই পরিস্থিতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসার বড় প্রতীক হলো পদ্মা সেতু। আমরা কনসোর্টিয়ামের ওপর নির্ভর করলে কখনোই পদ্মা সেতু করতে পারতাম না। এ জন্য আফ্রিকায় এখনো এ ধরনের প্রকল্প হয়নি। অর্থাৎ যেসব অর্থনীতি যত দিন পর্যন্ত তথাকথিত খয়রাতি সাহায্য (গ্রান্ট অ্যান্ড এইড) গ্রহণ করেছে, তারা কখনো তাদের অর্থনীতিকে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় নিতে পারেনি। আমরা এখন যে বড় প্রকল্পগুলো নিচ্ছি—ঢাকা মাস র্যাপিড ট্রানজিট, পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল, মাতারবাড়ী মেগা বিদ্যুৎ প্রকল্প, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র—এসব কখনোই নিতে পারতাম না, যদি আমরা নিজস্ব সম্পদের ওপর নির্ভরশীল না হতাম।
এরপর আমরা কী দেখলাম? যখনই আমরা বাজেটে বিরাট অঙ্কের টাকা নিজস্ব সম্পদ থেকে জোগান দিতে সক্ষম হচ্ছি, তখনই বিদেশিরা আমাদের সঙ্গে অংশীদারি নিতে আসছে। আমরা কি কখনো কল্পনা করতে পেরেছিলাম যে বাংলাদেশের বেসরকারি খাতে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে একেকটা প্রাইভেট কম্পানি? এখন এটা বাস্তবতা। বিদ্যুৎ খাতে গত ১০ বছরে যে রূপান্তর ঘটেছে, তার ফলে আজকে দুই-তৃতীয়াংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন বেসরকারি খাত থেকে আসে। এ ক্ষেত্রে সামিট পাওয়ার একটা উদাহরণ। এই উন্নতি মূলত সম্ভব হয়েছে আমাদের উন্নয়ন বাজেটে বিপ্লব শুরু হওয়ার পর থেকে; বিশেষ করে যখন আমাদের উন্নয়ন বাজেট এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেল, তখন থেকে।
আমার বক্তব্যটা হলো, নিজের প্রচেষ্টায় যখন কিছু হয়, তখন অন্যরাও হাত বাড়ায়। নিজেরা যখন দারিদ্র্য লালন করতে থাকি, তখন অন্যরা লিঙ্গবৈষম্য, মানবাধিকার, দারিদ্র্য বিমোচন ইত্যাদি ইস্যু সামনে রেখে খয়রাতি সাহায্য নিয়ে হাজির হয় নানা শর্ত দিয়ে। এভাবে আমরা ২০-৩০ বছর চলেছি। কিন্তু লাভ হয়নি। এখন আমরা উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটা পথ খুঁজে পেয়েছি। সেটা হলো নিজেদের প্রচেষ্টা এবং নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি। তাই উন্নয়নটা করতে হবে দেশের জনগণকে, দেশের সরকারকে। উন্নয়নটা বিদেশিরা এসে করে দেবে—এই আশাটা এখনো যদি কেউ করে থাকে, তাহলে সেটা আমাদের ত্যাগ করতে হবে। আমরা যদি এই ফাঁদ থেকে আগেই বের হতে পারতাম, আরো ভালো হতো। একসময় তো মনে করা হতো, বাংলাদেশে বিদ্যুতের সমস্যা যাবেই না। বিদেশিরাও তা-ই মনে করত। কিন্তু এখন আমাদের বিদ্যুৎ সারপ্লাস।
এখন আমাদের জন্য প্যারিস কনসোর্টিয়াম নেই। দরকারও নেই। আমরা যে পদ্মা সেতুতে শক্তভাবে হাত দিতে পেরেছি, সেটা উদাহরণ হয়ে থাকবে। যদিও খরচ বেড়ে গেছে এবং সময় বেশি লেগেছে, তার পরও আমি বলব, এটা আমাদের জন্য একটা শোকেস। বাংলাদেশ বা এ ধরনের একটা ইকোনমি নিজেরা কিছু করতে পারে—পদ্মা সেতু হলো সেই সক্ষমতার একটা প্রদর্শনী।
এই পর্যায়ে এসে আমাদের আরেকটা দিকে নজর দেওয়া দরকার। সেটা হলো সরকার অবকাঠামোগত অনেক সম্পদ (অ্যাসেট) তৈরি করছে। এখন উচিত শেয়ারবাজারের মাধ্যমে সেগুলো বেসরকারি খাতে বিক্রি করে দেওয়া, যাতে বেশি অর্থ ফেরত আসে। সেই অর্থ দিয়ে অন্য বড় প্রকল্প নেওয়া যাবে। এ ক্ষেত্রে আমাদের পলিসি লেভেলে এই ঘাটতিটা এখনো রয়ে গেছে। সরকার অ্যাসেট তৈরি করল, আবার নিজেই চালানো শুরু করল, এটা হয় না। সরকারকে বুঝতে হবে, ব্যুরোক্রেসি দিয়ে ব্যবসা চালানো যায় না। বরং সরকার ওই সম্পদ বা অ্যাসেটকে কম্পানি হিসেবে লিস্টিং দিয়ে শেয়ারবাজারের মাধ্যমে জনগণের কাছে বিক্রি করলে সরকার হাজার হাজার কোটি টাকা পেতে পারে। তাতে আমাদের জিডিপিও বাড়বে। যে বড় বড় সেতু আমরা দেখছি, সেগুলো যদি কম্পানি করে দেওয়া হতো, তাহলে এর টাকা দিয়ে আরো বহু সেতু করা যেত। বড় বড় অবকাঠামো তৈরি করে সেগুলো নিয়ে সরকারের বসে থাকা ঠিক হবে না। এগুলোকে বাণিজ্যিক রূপ দিয়ে জনগণের কাছে শেয়ারবাজারের মাধ্যমে বিক্রি করা উচিত।
লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
অনুলিখন : আফছার আহমেদ
Leave a Reply